দিন বদলায়

সারাটা দিন ধরে আমরা যত বকবক করি,  তার মধ্যে জেনারেশন গ্যাপ’ ব্যাপারটা নাছোড়বান্দা  পুরোনো অভ্যেসের মত ফিরে ফিরে আসে ,তা শব্দরূপেই হোক বা ধারণারূপেই হোক; বহু ব্যবহারে ক্লিশে হয়ে গেলেও আসে। হয়তো বা এই বিশেষ  শব্দবন্ধ উচ্চারণ করি না সারাক্ষণ, কিন্তু একটু খেয়াল করলেই বোঝা যায় দিনের মধ্যে ন্যূনতম বার পঞ্চাশেক ‘আমরা আদৌ এটা করতাম না’, ‘আমাদের সময় কিন্তু ওইটা হত না’, ‘আমরা এমন টা দেখিনি বাপু’ – চলতেই থাকে। বলার সময় স্মরণে থাকে না যে প্রকারান্তরে আমরা সেই অতি প্রচলিত ‘জেনারেশন গ্যাপ’ বা  প্রজন্মগত ব্যবধানের কথাই হয় ভাবছি আর নয়তো বলছি।     

আমাদের যাদের, অন্তত একটি পরবর্তী প্রজন্ম রয়েছে তারা বেশ জানি আর বুঝি এই আপাত-নিরীহ, চেনা – অচেনা ফাঁকটুকু কোথায়, মনের কোন কোণায়, কোন সুরে লাগে আর কোন তারে বাজে। ভালো-খারাপ, উচিত-অনুচিত, ঠিক- বেঠিক, ভুল-বেভুল  – এই বিচারে যাচ্ছিই না, শুধু কখনো কখনো এটুকুই মনে হয়,  এ ব্যবধান কেবল চেতনার কোনো এক  অজানা স্তরে ছোট্ট করে টোকা দিয়ে বলে যায়  হয়তো বা ‘আমার দিন ফুরালো’;  ‘ব্যাকুল বাদল সাঁঝে’,ই হোক  বা ‘মধ্যদিনের বিজন বাতায়নে’ই হোক।

যাক, মন খারাপের কথা থাক, একটু বাস্তবে ফিরি। এই যে দুটো প্রজন্মের ফাঁক, দুটো কালের ব্যবধান, এই ফাঁকটুকুর দু্টো  রূপ আছে সম্ভবত। একটা বহিরাঙ্গ আর  একটা অন্তরাত্মা – এই দুই  প্রকাশভঙ্গীর সম্পর্ক কতটা নিকট আর ফারাকই বা কতটা,  তা বুঝতে গেলে আগামী কে যেমন জানতে হয়, নিজেকেও তেমনই চিনতে হয়।

নিজের ভাবনাটুকু খানিক বিশদে বলি। ধরা যাক, চিরাচরিত বধূবরন এবং পরবর্তী প্রথাগুলি আমাদের পরীক্ষণের মূল বিষয়বস্তু।

কাট ওয়ানঃ সাল ২০০০ –  বউমা ঘরে পা দিল। সোজা ঠাকুরঘর হয়ে রান্নাঘর – ভরভরন্ত চাল ডাল, মাছ তরকারি- আহা- কায়মনোবাক্যে বউটিকে শ্বশুরবাড়ির গামলা ডেকচি, হাঁড়ি কড়াই ভর্তি খাদ্যের আজীবন যোগানের জন্য প্রা্র্থনা করতে হল; এরপরের পর্ব আশীর্বাদ প্রণাম, উপহার, বালখিল্য খেলাধুলো। তারপর টুকুস করে বরবাবাজী কেটে পড়লো ঘুমোতে, বউটি চলল কালরাত্রি পালন করতে কোনো এক অজানা, অচেনা ননদ, বউদি, জা ইত্যাদি প্রভৃতির সঙ্গে। কি বিরক্তি, কি বিরক্তি, ক্লান্তি তে শরীর ভেঙ্গে পড়লেও মুখে হাসি, চোখে ভক্তি রেখে কর্তব্যপালনে অটুট।  

কাট টুঃ সাল ২০২৩ –  প্রথম পর্ব গুলি কোনোমতে সমাধা করলেও শেষ পর্বে এসে একটি শিক্ষিত বউ অনায়াসে বলে দেয়, এক্সকিউজ্ মি, আমি একটু প্রাইভেট্ পারসন্, একটা সেপারেট রুম হলে ভাল হোতো।

আমি এই মেয়ে টিকে একটুও অভদ্র মনে করি না। আমার পূর্ববর্তী প্রজন্ম কিন্তু তা করে।

এই মেয়েটি কাউকে ব্যাক্তিগত স্তরে দুঃখ দেয়নি এবং একই সঙ্গে তার চিন্তা ধারার বহিঃপ্রকাশ আর অন্তরাত্মার বিরোধও ঘটতে দেয়নি। নিজের ইচ্ছেটুকু স্পষ্ট ভাবে সর্বসমক্ষে বলার সাহস রেখেছে। একে কেউ কেউ দুঃসাহস বা স্পর্ধা বলে থাকেন। আমার মনে হয় এখানেই প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের ব্যবধান তার বিস্তার ঘটায়- যেখানে মূল ভাবনা অনেক সময়ই এক, কিন্তু তা স্বীকার এবং প্রকাশ করার ভঙ্গীটুকু শুধু আলাদা। এই বিভেদটুকুই কি জেনারেশন গ্যাপ’এর কলকাঠি নাড়ে?

আর একটা উদাহরণে যাওয়া যাক।

দৃশ্য একঃ ২০০০ সালে চাকরী পাওয়া এক তরুণ বা তরুণী প্রথম মাইনের টাকায় সকলের জন্য উপহার নিয়ে গলদঘর্ম হয়ে হাসিমুখে বাড়ি ঢুকলো। মা এর শাড়ি, বাবার পাঞ্জাবি, ভাইবোনেদের কলম কিংবা ছোট্ট সুগন্ধী শিশি সঙ্গে মিষ্টি র বাক্স – এ দৃশ্য আকর্ষণীয় ছিল না, এ কথা কেউ বলতে পারবে না। আশীর্বাদ স্বরূপ পেত প্রচুর উপদেশ যথা সৎপথে চাকরী করা, সকলের সঙ্গে সদ্ভাব বজায় রাখা, নৈতিক স্খলনের পথে না যাওয়া এবং সর্বোপরি সকলের দায়িত্ত্ব নেওয়া। সে তার জীবন দিয়ে তা পালন ও করতো।

দৃশ্য দুইঃ  ২০২০ সালে সদ্য চাকরী পাওয়া একটি তরুণ বা তরুণী –  এর কাছে পেশাগত প্রয়োজন সর্বাগ্রে । তার জন্য সে সব করতে প্রস্তুত। উচ্চকন্ঠে বলতে পারে ‘যা করেছি, বেশ করেছি; উন্নতির জন্য যা যা করতে হয় সব করব’; এক্ষেত্রে অল্পবিস্তর মিথ্যে, টুকটাক পারিতোষিক – সব, স-অ-অ-ব চলবে। আর প্রথম বেতনে সবার জন্য উপহার? নৈব নৈব চ। অহেতুক খরচ অর্থহীন। থাকবে শুধু বান্ধবীকে উপহার  আর বন্ধুদের সঙ্গে কোনো একদিন একটু পানভোজন, নিশিযাপন, একটু দুরন্ত গতিতে নৈশভ্রমণ।

এক্ষেত্রে আমার দ্বিতীয় মানুষটিকে বেশ স্বার্থপর মনে হয়। আমার পরবর্তী প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের কিন্তু তা মনে হয় না। তারা বলে ‘ঠিকই তো করছে, উন্নতির জন্য, ভাল থাকার জন্য এটুকু তো করতেই হবে। নিজের জন্য ভাল, আরও’ ভাল, “আরও আরও” ভাল চাওয়ায় কোনো দোষ নেই তো ? আর সেটা করতে গেলে একটু স্বার্থকেন্দ্রিক তো হতেই হয়’।

এখন একথা সত্যি যে এই যুক্তির বিপক্ষে বলার মত খুব জোরালো যুক্তি আমার কাছে নেই। তাও কেন সমর্থন যোগ্য মনে হয় না ওদের যুক্তি? এটাও কি সেই ‘জেনারেশন গ্যাপ’? হয়তো তাই।

ভাল থাকতে সবাই চায়, যে কোনো যুগে, যে কোনো সময়। একটা যুগ ভাল থাকতো সবাইকে নিয়ে, আরেকটা যুগ ভাল থাকে নিজেরটুকু নিয়ে। এদের মধ্যে ঠিক ভুলের বিচার করা বড় কঠিন কাজ। চিরাচরিত ধারণার বাইরে না গেলে বোঝা মুশকিল এই দ্বন্দের উৎস কোথায়। আসলে ঠিক-ভুল, ভাল-মন্দ এই প্রত্যয়গুলো অনেকাংশেই সামাজিক নির্মাণ, আমরা আলাদা করে নিজেদের বিচার বিবেচনা দিয়ে আর ভাবি না এদের নিয়ে। আর এখানেই প্রবেশ ঘটে ‘জেনারেশন গ্যাপ’ এর। যত প্রজন্ম এগোতে থাকে, তত এই সামাজিক নির্মাণের বেড়া ভাঙ্গার প্রবণতা বাড়ে। মানুষের ভাল মন্দ সে নিজের সুবিধে অনুযায়ী ঠিক করে, সমাজ কি বলবে তা ভেবে নয়। এতে অন্যায় আছে কি নেই সে প্রশ্ন তোলা অর্থহীন।

তবে আবার যদি বাস্তব থেকে একটু আবেগের দরজায় ঘা দিই, মন একটু কেমন কেমন করে বইকি; সেই ভীতু ভীতু মুখের  বাচ্চাগুলোর জন্য, যারা কেবল ভয় ই পেতে শিখেছিল – প্রশ্ন করতে শেখেনি, সেই কিশোর বেলার  লাজুক লাজুক মুখগুলোর জন্য যারা সিনেমা জগতের হিরো-হিরোইনদের দেখে চুল কাটতো , জামা পরতো আর বাড়িতে টীকাটিপ্পনি খেতো , আর সেই সব সরল তারুণ্যে ভরপুর নববিবাহিতদের জন্য যারা প্রত্যাশা করতো তার সঙ্গী টি তার সব না বলা কথা জ্যোতিষীর মত বুঝে ফেলবে। এখন আর এদের খুঁজে পাওয়া যায় না। ভালই তো। কিছু অনুভূতি, কিছু বোধ না হয় স্মৃতি হয়েই থাকুক, সময় এগিয়ে যাক নিজের ছন্দে। নতুন প্রজন্ম আসুক, নতুন প্রত্যয় আসুক। বিভেদ তো থাকবেই, তারই মাঝে কোথাও একটা অন্ত্যমিল খুঁজে নেওয়ার চেষ্টাটুকুও থাকুক।

সকলে ভাল থাকবেন। ছোটোরা, বড়রা সবাই আনন্দে থাকুন। পুজো আসছে।  

4 thoughts on “দিন বদলায়

  1. Khub bhalo laglo, je proshno protidin proti muhurto nijeke bibroto korche tar ekta shundor upasthapona ei lekhay, bar bar porrte ichche korche

  2. Tomar lekha podte besh lage…. Ei lekha tao darun bhabnar bohiprokash….. Notun lekhar opekhay roilam.

  3. Opurbo. Bhishon shundor kore amader pratyohik jibone cholar pothe dhakka khete thaka moner kothaguloke phutiye tulli. Onobodyo lekhata. Eto shabolil r shundor bhabe bastob er kotha gulo, jegulo amra keui bhashae phutiye othate parina, sheta ki shotosfurto bhabe prokash korli. Lekha ta chaliye jaa.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error

Enjoy this blog? Please spread the word :)