আর একবার যদি (২)

তখন খুবই ছোটো। ক্লাস টু বা থ্রি  হবে। আমার এক ঠাকুমার বাড়ি মাঝেমাঝেই যেতাম। খুব আদর করতেন। কত গল্প যে বলতেন। ঘর জুড়ে তার মেঝে থেকে ছাদ পর্যন্ত চার দেওয়ালে বই, শুধু বই। প্রতিবছর পুজোর পর যখন বিজয়া করতে যাওয়া হত, দেখতাম খাটের ওপর কম করে হলেও গোটা  তিরিশেক পুজোবার্ষিকী। ভাবতাম একটা শেষ করতেই তিন মাস লাগে আমার, এত কবে পড়া হয় কে জানে! শীতের দিনে, একটা বড় দেখে তুলোর লেপ ছড়িয়ে দিতেন খাটের ওপর। সব কুচোকাচারা ওনাকে ঘিরে ওই লেপের তলায় পা ঢুকিয়ে বসতো। তারপর ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমী, রাজপুত্র-রাজকন্যে, ঘোড়াশালে ঘোড়া, হাতিশালের হাতি, ঝকঝকে তলোয়ারের শনশনে আওয়াজে রাজায়-রাজায় যুদ্ধ – ঝড় তুলতো ঠাকুমার বিছানায় আর কুচোদের লেপে। একের পর এক টুকরো টুকরো ছোটোবেলা জুড়ে আছে সেইসব রূপকথার পরতে পরতে। গপ্পের খিদে মিটলে শুরু হত আসল খিদের আয়োজন। মনে পড়ে হিং-এর কচুরী বানাতেন রান্নাঘর লাগোয়া একটা কাচ  ঢাকা বারান্দা মত জায়গায়, স্টোভে। স্বাদ  ভোলবার নয়।  নিজের হাতে তৈরী আচারও দিতেন সবাইকে যত্ন সহকারে। একবার বাবাকে বললেন, “জানিস তো, আমার এক একটা গয়না আস্তে আস্তে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে”; ঘর ভর্তি সবার জিজ্ঞাসু  চোখের দিকে তাকিয়ে হেসে বললেন, “প্রথমে চোখটা গেল, এখন কানেও কম শুনছি, গন্ধটা কতদিন পাই দেখা যাক”। সেদিন এ রসিকতার বিন্দুবিসর্গ না বুঝলেও আজ আশ্চর্য হয়ে ভাবি এ তুলনা কত বড়  অমোঘ সত্যি। ইন্দ্রিয়ের সজাগ সজীবতা যে কত দামী অলঙ্কার তা মরমে মরমে উপলব্ধি করার পরিপক্কতা আজ এসেছে দুর্ভাগ্যক্রমে।  

রাতের বেলায় লিখতেন। সারারাত। এত সাধারণ ‘দিন’যাপন যার, রাতের নিকষ অন্ধকারে তার কলমই দিয়ে গেছে সত্যবতীর সমাজকে দেওয়া প্রথম প্রতিশ্রুতি, সুবর্ণলতার অসম যুদ্ধ আর বকুলের নীরব নম্র অহংকারের সাক্ষর।  

আশাপূর্ণা দেবী আমার ঠাকুমার নিজের বড়দি। আমার ঠাকুমা তার পুত্রের পাঁচ বছর বয়সেই এ সংসারের মায়া ত্যাগ করে অন্য ঠিকানায় পাড়ি দিয়েছিলেন। তাই মা-হারা বোনপোটি মাসিদের খুবই আদরের ছিল। সেই সুত্রে আমিও তার কিছু প্রসাদ পেয়েছি। কত বই যে দিয়েছেন গুণে শেষ করা যাবে না। আজ খুব মনে হয়, আর একবার যদি ওই দিনগুলো একটু পিছুপা হয়ে দেখা করতে আসে, সবকটাকে শিকল পরিয়ে রেখে দেব। কত বই , ওনার সই করা, হারিয়ে গেছে কোথায় যেন। সময় বিশ্বাসঘাতক। কিছু ধরে রাখতে পারে না।  মনে হয়, একটা যদি ছবি তুলে রাখতাম – তখন কোথায় মোবাইল, একটু যদি ওনার কথা রেকর্ড করে রাখতাম – তখন কোথায়ই বা ভয়েস রেকর্ডার।  অমন অসাধারণ মানুষের দেখা, ছোঁয়া তো আমার মত নিদারুণ সাধারণ মানুষ আর পাব না এ জীবনে।

  আজ শুধু ওই লেপের নরম তুলোর ওম, ওই পক্ষীরাজের ডানায় লেখা গল্পগুলো, কচুরীর হিং-এর এক ছটাক গন্ধ আর কয়েকটা হলুদ হয়ে আসা পাতাওয়ালা বই-এর প্রথম পাতায় সই “স্নেহাশীর্বাদসহ আশাদিদা” এইটুকুই আছে আমার কাছে। শেষ সম্বল, অশেষ সম্পদ। স্মৃতি আর সময়ের ওপর মোটে ভরসা নেই, তাই এটুকুই কলমবন্দী করে রাখলাম আজকের ‘আর একবার যদি’র এই পর্বে।

ভালো থাকবেন।

One thought on “আর একবার যদি (২)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error

Enjoy this blog? Please spread the word :)