টুকরো ছবি,টুকরো হাসি

আমার ছোটো ছেলেটা তখন তিন বছরের। জ্যেষ্ঠটি তার থেকে এক মিনিটের বড়। একবার দুই সুপুত্রের কান্ড কারখানায় অতিষ্ঠ হয়ে একটু বেশিই রেগে গেছিলাম। দোষের মধ্যে বলেছি ‘আমি মরলে বাঁচি।’ একথা কোন মা না বলেছে শুনি? এটা সবার শোনা। যেটা শোনা নয় সেটা হল আমার পুত্রের উত্তর। সে মিনিট খানিক থম্কে কোমরে হাত রেখে বিজ্ঞের মতো বললে,“তা বাড়ির দরজার নীচের ছিটকিনি তো আমরাই খুলতে পারি, ওপরের ছিটকিনি তে তো হাত যায় না, বাবা অপিস থেকে ফিরলে দরজাটা কে খুলবে শুনি?” সেদিন কি করেছিলাম মনে নেই, তবে আজও ভাবলে দোটানায় পড়ি, সেই মুহূর্তে হাসা, নাকি কাঁদা,  নাকি রাগের মাথায় যেটা বলে ফেলেছিলাম সেটাই করা উচিত ছিল।  

আমার তখন এম ফিলের থিসিস লেখা চলছে। বাড়িতে আমি,  আমার কম্পিউটার, এবং দুই গুণধর পুত্র। দুই মহাপুরুষের প্রবল খেলা, লম্ফঝম্প চলছে। ঠাৎই সব চুপ।  এক্টু অবাক হলাম; এও ভাবলাম, যতই হোক, যেমনই দেখতে হোক আর  যা’ই আচরণ করুক, মানুষ তো, হয়তো ক্লান্ত হয়ে পড়েছে, একটু জিরিয়ে আবার শুরু করবে। নাহ্, তা হল না। খানিক পরে দেখি বড় পুত্র মাথার পিছনে হাত চাপা দিয়ে ঘরে প্রবেশ করলেন। চোখে জল। “ছোতু ধাক্কা দিয়েছে, আমাল লেগেছে । মাতায়।“  গেলাম , মাথায় খানিক বরফ ঘষলাম। ছোতু মানে ছোটু, তার অতীব শান্ত, নিরীহ কনিষ্ঠ ভ্রাতা। এরকম হামেশাই হয়ে থাকে, অতএব লেখায় পুনরায় মনোনিবেশ করলাম। খানিক পরে আবার সে ফিরে এল। চোখে আরো জল আর হাত ভর্তি রক্ত।  বিষম চমক খেলাম। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ব্যাপার বুঝতে  দেরী হল না। মাথার পিছনে হাত দিয়ে দেখি আঘাত গুরুতর, রক্তপাতও যথেষ্ট । আমার হাতও রক্তে ভরে গেলো। ছেলের দ্বারা  বর্ণিত ঘটনার বিশদ বিবরণে অবগত হলাম, সে যখন ছু্টছিল, তখন তার ভাই , মাথায় প্রচুর সুবুদ্ধির  দরুণ ঠাৎই দাদার পা’টি  পিছন থেকে হালকা করে টেনে ধরে,    ফলস্বরূপ দাদা তৎক্ষণাৎ পড়ে যায়। তখন দুর্ভাগ্যক্রমে মাথার মাঝখানটি কাঠের দরজার ধারালো দিকটিতে ধাক্কা খেয়ে অল্প করে দুফাঁক হয়ে যায়। কয়েক সেকেন্ড থতমত খেয়ে প্রথমেই ‘ছোতু’র খোঁজ পড়ে। এ হেন কান্ডের হর্তা কর্তা বিধাতাকে তখন আর ঘটনাস্থলে দেখা যায় না। কোথায় ঘাপটি মেরে ছিল কে জানে। যাই হোক আমি এক হাতে রক্ত নিয়ে আর এক হাতে ফোন লাগালাম পুত্রদ্বয়ের পিতাকে। তিনি রাস্তায় ছিলেন অপিস ফেরতা পথে। ‘মাথা ফাটা’ কে শুনলেন ‘হাত ভাঙ্গা’। কিছুতেই ভাঙ্গা আর ফাটার  তফাত করা গেল  না ফোনে।  এদিকে ছেলের মাথায় হাত দিয়ে দেখি আরো রক্ত।  আমার মাথা কাজ করছে না। বসবার ঘরের গোল টেবিলের চারদিকে গোলগোল করে ঘুরতে ঘুরতে বলতে লাগলাম, ‘হে ভগবান কি করি, হে ভগবান কি করি’। ওমা! খানিক পরে দেখি, ছেলেও মাথার পিছনে হাত চেপে আমার পিছুপিছু ঘুরছে আর আওড়াচ্ছে  “হে ভগমান কি করি, হে ভগমান কি করি?” আবার দেখি তার পিছুপিছু চক্রাকারে ঘুরছে ঘটনার মূল হোতা, খলনায়ক; আমার ছোটপুত্র ‘ছোতু’।  দাদার পিছু ছাড়ে না, আর আমার দিকে তাকায় না। সেই মুহূর্তে ক্ষমা পরম ধর্ম মনে করে ওটাকে ছেড়ে দিলাম।  

এবার পিতা হাজির। এসেই ছেলের হাত ধরে টানাটানি, ‘কোন হাত ভাঙলো? কি করে ভাঙলো?, কেন ভাঙলো?’  অনেক কষ্টে বোঝানো হলো হাত নয়, ভেঙেছে মাথা। তারপর আর কি; হাসপাতাল, সেলাই, ওষুধ, ব্যান্ডেজ ,  দিদার বাড়িতে প্রচুর আদর আর ভাত খেয়ে দুইজন বাড়ি এলেন, মাথা ঠাণ্ডা হল খানিক। কপালে ফেট্টি বাঁধা ছেলেকে কোলে নিয়ে শুধোলাম, ‘হ্যাঁ রে, তুই অমন হে ভগবান কি করি, হে ভগবান কি করি করিছিলি কেন? আমারটা শুনে শুনে বলছিলি?’ একগাল হেসে সে বললে, “হে ভগমান কি করি?” তখনও তার ব আর ম এর উচ্চারণ আলাদা করবার বয়স হয়নি।

  এবার একটু বিদ্বানদের বিদ্যালাভের ইতিহাস না বললেই নয়। ছোটোটা তো বরাবরের সাহসী, শুধু অন্ধকার, ছায়া,  সাদা শাড়ি, চোখ খুবলে যাওয়া ডলপুতুল, দূরে দুলতে থাকা দোলনা আর বিভিন্ন জাতের খাঁটি ভূত ছাড়া সে আর কিছুতেই ভয় পেত না। তা তার লেখা রচনাতেও সেই সাহসের কমতি ছিল না। প্রতিটা ইংরেজী এবং বাংলা রচনায় তার বীরপুরুষত্ব ফুটে উঠবেই উঠবে। একবার রচনার বিষয় ছিল ‘স্মরণীয় ভ্রমণকাহিনী’। সে  তো গেল গভীর জঙ্গলভ্রমণে। বনে বাদারে অকুতোভয় ছেলে আমার ঘুরে বেরানোর  পর কি হল? তিনি নাকি বাঘের মুখোমুখি হলেন। যে সে বাঘ নয়, খোদ রয়েল বেঙ্গল  টাইগার। দলের সবাই তো ভয়ে কাঁপছে, কিন্তু সে? সোজা গিয়ে রয়েল বেঙ্গলের গালে কষিয়ে এক থাপ্পড় – ব্যাস্, আর কি? চরিদিকে ধন্যধন্য রব। “পরেরদিন কাগজে, টিভিতে – সে এক কান্ড বটে”- এই বলে রচনা শেষ হল। ইংরেজীতেও তিনি কম যান না,  ‘সাহসিকতার অভিজ্ঞতা’র ওপর রচনায় লিখে এলেন কিভাবে তিনি একটা ডুবন্ত ছোট্ট শিশু কে গভীর জলের তলা থেকে একা সাঁতরে তুলে এনেছিলেন। তারপর তো সম্বর্ধনা, সম্মাননা, রাষ্ট্রপতি পুরস্কারের ছড়াছড়ি। নিত্যনতুন  রচনায় নব নব কীর্তি। শুধু একটাই বস্তু অটল, অবিচল – শেষ বাক্য। বাংলায় তা ছিল “বাকিটা সবাই তো খবের কাগজে জেনেই গেছেন, নতুন করে আর কি বলব বলুন…”, আর ইংরেজীতে  অবশ্যম্ভাবী পরিসমাপ্তি ছিল “রেস্ট  ইজ্ হিষ্ট্রি।“       

বড় ভাই, অর্থাৎ আরেক পণ্ডিত ছিল খানিক সোজা সরল প্রকৃতির। একবার বাংলায় যব  দিয়ে বাক্যরচনায় লিখে এল “এতখানি বয়েস হল, ছেলেটা এখনও যবলেস।“ আবার মনে মনে নির্ঘাত কিছু খচ্খচ্ করেছিল, তাই ব্র্যাকেটে লিখে এল (যবলেস=বেকার)। পরে বিশাল একখানা গোল্লা খাওয়ার আগে অব্দি তার মেনে নিতে খুবই অসুবিধে হয়েছিল যে যব একটি শস্যের নাম। বাংলায় এই পাণ্ডিত্য নিয়ে বোর্ড পরীক্ষায় বসার কথা। ঠিক তার আগেআগেই ছিল সরস্বতী পুজো। নির্দেশ ছিল চান করে একবার ঠাকুর নমস্কার করবার। কিছু পরে এসে সগর্বে বলল, “এক টাকা দিয়ে এলাম মা”- বললাম  ‘আচ্ছা’। খানিক পর আবার এল,  “বাংলা পরীক্ষাটা বাকি আছে, পুরোপুরি পাঁচই দিয়ে এলাম, বুঝলে?“ মা সরস্বতীর সামনে তখন চক্চকে পাঁচ টাকার মুদ্রা।  

 বলা বাহুল্য মা সরস্বতী এই পারিতোষিকে প্রীত হ’ননি, কৃপাও করেননি । বাংলায় এই নির্বুদ্ধিতার ফল ভবিষ্যতে  সে যথেষ্টই পেয়েছে যা প্রকাশের অযোগ্য।  

শেষ করব তাই দিয়েই, যা দিয়ে শুরু করেছিলাম। এক্ষেত্রে আমারও দোষ আছে বৈকি; মৃত্য়ু নিয়ে যে সার্বিক কৌতূহল সকলের থাকে, আমার তা কিঞ্চিৎ বেশিই ছিল। ‘মরণ রে তুঁহু মম শ্যাম সমান’  কবির এই পঙ্কতিটি আমার বড় প্রিয়। দুখী দুখী গলায় এবারে বলেছিলাম, ‘তোরা বড্ড অলস, একটা কাজ করিস না, নড়তে চড়তে দশ ঘন্টা! জানিস, যখন আমি ছবি হয়ে দেওয়ালে ঝুলবো তখন রোজ  বাজারে গিয়ে টাটকা ফুলের মালা নিয়ে এসে পরাতে হবে, কি করবি তখন, কুঁড়েমি করতে তো পারবি না?’ উত্তর এল, “আগে থেকে টাটকা ফুলের মালা পরে একটা ছবি তুলে রাখলেই তো হয়, সমস্যা থাকে না আর।“ এরপর থেকে ও পথ আর মাড়াই না, শুধুই জীবনমুখী গান গাই।  

ভাল থাকবেন। ‘হাসি’তে থাকবেন।  

10 thoughts on “টুকরো ছবি,টুকরো হাসি

  1. Just darun lekha , prochur heshechi aar amader chotobabu borrobabu ke onek onek bhalobasha aar ador, eto spontaneous shob innocent kintu sincere reactions !!

  2. Oshadharon. Ek jholoke bolu chhotu r chhotobela te jeno phire gelam. Shei shob shundor muhurto gulo… Ajo jeno eki rokom ache. Boddo bhalo lekha ta.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error

Enjoy this blog? Please spread the word :)