সেই কোন প্রাগৈতিহাসিক যুগে যেবার মাধ্যমিক পাশ করলাম, আমার আর আমার বাড়ির লোকেদের থেকেও উনি বোধহয় বেশি খুশি হয়েছিলেন। আমার মার্কশীট এর জেরক্স কপি নিয়ে গিয়ে পাড়ার লোকদের ডেকে ডেকে জিগ্যেস করা শুরু করলেন, ভাই আপনার ছেলে কেমন করল?…..দাদা আপনার মেয়ে এবার মাধ্যামিক দিল, না? তা কত পেল? যদি তারা বেশি পেত কথা বিশেষ বাড়াতেন না, কিন্তু যদি কম পেত – ব্যাস, হয়ে গেল। ঝুলির বেড়ালের মত পকেট থেকে বেরোতো সেই মার্কশীট; হে হে দেখুন তো দাদা এটা, আমার ভাইঝির রেজাল্ট, হে হে আপনারা তো অল্পেই খুশি, এটা কেমন বুঝছেন …হে হে……
……শুনে তো গড়পড়তা রেজাল্ট করা আমি ধরণীর দ্বিধা হওয়ার অপেক্ষায় মরীয়া ।
চিত্তরঞ্জন সেনগুপ্ত আমার নিজের কাকা ন’ন, কোনো আত্মীয়ও ন’ন। আমার বাবার অভিন্নহৃদয় বাল্যবন্ধু, আমাদের চিত্তকাকা। অকৃতদার, বন্ধুবৎসল, সদাহাস্যময়, স্নেহপ্রবণ চিত্তকাকা ছিলেন আমার শৈশবের আনন্দের খনি, খুশির কারখানা। উনি বাড়ি আসলে কলিং বেল নয়, টোকা নয়, বাড়ির দরজার মাথায় লাগানো শিকল ধরে তিনবার ঠক, ঠক, ঠক শব্দ করে বাবার নাম ধরে হাঁক পাড়তেন, বাদ-ও – ও -ল। কি মজা যে হত আমার তখন।
আমার তখন ছয় কি সাত। নিজের পান্ডিত্য প্রকাশের এক অভিনব পন্থা উদ্ভাবন করেছিলাম। কাকার আসার সংকেত পেলেই ছুট্টে গিয়ে পুরোনো ছিঁড়ে যাওয়া বর্ণপরিচয়খানা নিয়ে বসে পড়তাম সোফায়। যেই না বসতেন উনি, শুরু হয়ে যেত আমার প্রশ্নবাণ। বিদ্যাসাগরমশাই এর সেই সব আসামান্য শ্বাসরুদ্ধ এবং বাক্রুদ্ধ করা বানান ধরতে শুরু করতাম, একের পর এক – “নিঃসৃত, দুঃশীল, নিঃশেষ, স্বদেশ, শ্বশুর” – কঠিন থেকে কঠিনতম বানানের গুঁতোয় প্রাণ ওষ্ঠাগত করে ছাড়তাম। খুবই ধৈর্য্য সহকারে হাসিমুখে নতিস্বীকার করে আমায় জিতিয়ে দিতেন তিনি- প্রত্যেকবার, প্রতিমুহূর্তে।
তখন ক্লাস থ্রি কি ফোর এ পড়ি। একবার খুব রেগে গিয়েছিলাম। আমাদের বাড়িতে সাপ্তাহিক ভ্রমণের সময় ওনার হাতে আবধারিত ভাবে উপস্থিত মিষ্টির বাক্স। আমি খুব অধৈর্য্য হয়ে বলেছিলাম, এক-আধবার এক ডজন ডিম আনলেও তো পারেন? কারণ আমি মিষ্টি খেতাম না! সে কি অট্টহাসি ওনার আর বাড়ি শুদ্ধ সকলের। পরেরবার কবিরাজী কাটলেট এনেছিলেন যাদবপুর কফি হাউজ থেকে।
জন্মাষ্টমীতে মা তালের বড়া করতেন। খানকতক খেয়ে গান ধরতেন, “তালের বড়া খেয়ে নন্দ নাচিতে লাগিল” আর আমরা তালি দিতাম।
আর ছিল কালীপুজো। কি অপরিমেয় আনন্দ যে পেয়েছি এই সময়টায় ওনার দৌলতে বলে বোঝাতে পারব না। চিত্তকাকা আর ওনার ভাই পুলক কাকা মিলে বানাতেন বাজি। বাড়িতে, দরজা জানলা বন্ধ করে, দিন-রাত জেগে, শুধু বন্ধুদের ছেলেমেয়েরা মজা করে ফাটাবে বলে মহাযজ্ঞের আয়োজন হতো। রংমশাল আর তুবড়ি- এই দুটোই বানাতেন। এদের আলোর ছটায় ঘোর অমাবস্যাতেও গাছের সব সবুজ পাতা, লাল টকটকে রক্তজবা, আর ওনার চোখের উপচে পড়া খুশির চিকচিকে রঙ সব স্পষ্ট বোঝা যেত। খালি চোখে চার পাঁচ তলা বাড়ির সমান উঠতো হয়তো, কিন্তু দৃশ্যমানতার বাইরে যে জগত, সেই রূপকথার রাজ্যে, যেখানে মাপজোকের হিসেব ছিল না, সেখানে যে কোন অসীমে হারিয়ে যেত ওই আলোর রোশনাই বুঝতে পারতাম না। এখন বড় বড় জায়গায় হাজার হাজার টাকার বাজি পুড়তে দেখি, অত রঙ আর অত ছড়িয়ে পড়া আলো কই? ছোট্টবেলার ওই বাজিতে লোহা, সোরা, গন্ধক , কাঠকয়লার সঙ্গে আর যে জাদু উপাদান থাকতো, সেটা এখন দুর্লভ, দুষ্প্রাপ্য।
এমন একজন মানুষ আজ সাতাশ বছর হল চোখের সামনে নেই, কিন্তু এটাই অবিশ্বাস্য লাগে যে তাঁর কথা মনে পড়লে কখনও শোক আসে না, শুধু একটা হাস্যোজ্জ্বল মুখ আর অপরিসীম প্রাণোচ্ছল সময় ভেসে ওঠে। আজও স্পষ্ট মনে আছে ফোনে হওয়া শেষ কথাটা। নিয়মিত ফোনের মতই ছিল সেদিনের ফোন। পড়াশোনা কেমন চলছে জিগ্যেস করে বললেন, “পড়, পড়, ভাল করে পড়” ……ব্যাস, ওই শেষ কথা। ওই গলা আর শুনিনি কোনোদিন।
এমন প্রত্যাশাহীন আদর, নিঃশর্ত ভালবাসা আর অবারিত স্নেহ-আব্দারের সুযোগ কমই পেয়েছি। বর্তমান জীবনের কঠিন বাস্তবময়তায় কাকার কথা খুব মনে পড়ে। খুব ইচ্ছে করে ওই শর্তহীন আদরের জগতটায় ফিরে যাই, যেখানে কেউ মনে করিয়ে দেবে না মেপে চলতে হয়, বুঝে বলতে হয়, কথা শুনতে হয়।
ইন্ডিয়ান রেলওয়ের একনিষ্ঠ সেবক চিত্তকাকা দূরপাল্লার রেলগাড়িতে কোন অজানার পথে রওনা হয়েছেন আজ বহুযুগ হল। হয়তো পৌঁছেও গেছেন গন্তব্যে। ভালই আছেন নিশ্চয়ই। এমন মানুষরা খারাপ থাকতেই পারে না। ওনার জন্মদিন দোরগোড়ায়- বড়দিনের দিন। এমন সঠিক দিনে জন্মদিন ই বা কজনের হয়। চার্চের ঘন্টা, ক্যারলের সুর, পাইন গাছের ঝিরিঝিরি পাতারা, কেকের সুবাস, লাল নীল হলুদ আলো, ওনার দেখে যাওয়া ছোটো একটা মেয়ে আর আমি একসঙ্গে আজ বলছি “শুভ জন্মদিন, ভাল থেকো”।
Very nice post on childhood. Wonderful .
Shotti eto shundor kore mone koriye dili!!
Odbhut bhalo laaga phire pelam!!